দুই শ শয্যার হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে আউটসোর্সিংয়ের (ভাড়া করা) জনবল আছে ১ হাজার ৩২০ জন। তাঁদের পেছনে বছরে ব্যয় হয় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি। অভিযোগ উঠেছে, একটি কোম্পানিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্যই কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই আউটসোর্সিংয়ে এই জনবল নিয়োগ দিয়ে আসছে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও বিপুলসংখ্যক জনবল থাকলেও তার কোনো প্রতিফলন নেই হাসপাতালের সেবায়।

দুই শ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স আছেন মোট ২১১ জন। এর মধ্যে ৯৫ জন চিকিৎসক, ১১৩ জন নার্স ও তিনজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। এর বাইরে বাকি সব জনবল আউটসোর্সিং করা হয়। টানা কয়েক বছর ধরে এসব কর্মী সরবরাহ করে আসছে আল-আরাফাত সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১ হাজার ৩২০ জনবল সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়, যার আর্থিক মূল্য ছিল ২ কোটি ৮২ লাখ ৩ হাজার ৩৩৬ টাকা। এরপর ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও চুক্তি নবায়ন করে একই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। এবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও পুনরায় একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত চিঠি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থ শাখায় পাঠানো হয়েছে। যদিও নিয়মানুযায়ী প্রতিবছর যথাযথ টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার কথা।

বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো মন্ত্রণালয় বা অফিস আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সেবার তালিকা, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুসরণ করতে হবে। সেবাদানকারীর শারীরিক সক্ষমতা থাকতে হবে। সেবা গ্রহণ ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ এবং প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮-এর আলোকে তা নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল এসব নিয়মের ধার ধারে না।

সরকারি হাসপাতালটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আল-আরাফাত সার্ভিস লিমিটেড প্রতিবছর ১ হাজার ৩২০ কর্মী সরবরাহের কার্যাদেশ পেলেও প্রকৃতপক্ষে হাসপাতালে এত কর্মী নেই। অর্থাৎ যত লোক সরবরাহ করার কথা, সেটা তারা করছে না। এ ছাড়া লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ-বাণিজ্য এবং ৪-৫ মাস পর আগের লোক বাদ দিয়ে নতুন লোক নেওয়ার মতো কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরেও অজ্ঞাত কারণে টেন্ডার ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানকেই নিয়মিত কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দুই শ শয্যার হাসপাতাল কোনোভাবেই ১ হাজার ৩২০ জন আউটসোর্সিংয়ের কর্মী পেতে পারে না। তারা কোভিডকালীন যে জনবলের অনুমোদন পেয়েছিল, সেটিই এখনো অনুমোদন করিয়ে নিচ্ছে, যা বিধিসম্মত নয়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, নিয়মানুযায়ী প্রতিবছর টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে হবে। তবে আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে চুক্তি নবায়ন করা যেতে পারে।

শুধু আউটসোর্সিংয়ের কর্মী নিয়োগে নয়, হাসপাতালের আসবাব কেনার ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ আছে। জানা যায়, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে ২৫ ধরনের আসবাব কিনতে ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৫০৫ টাকা কার্যাদেশ দেওয়া হয় গণপূর্ত ই/এম কাঠের কারখানা বিভাগকে। তবে পুরো টাকা বুঝে পেলেও মাত্র ৭ ধরনের আসবাব সরবরাহ করে গণপূর্ত। সেগুলোর সংখ্যা এবং মানও যথাযথ নয়। কোটি টাকায় কেনা ব্যবহারের অনুপযোগী এসব আসবাব হাসপাতালে এদিক-সেদিক পড়ে আছে। এই কেনাকাটায় পুরো টাকাই গচ্চা গেছে বলে মনে করেন হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি পিডব্লিউডি উড ওয়ার্কশপ ডিভিশন থেকে সাত ধরনের মালপত্র হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়। চালানে মালের বিবরণী অনুযায়ী এসব আসবাবের মধ্যে ছিল ৪৫টি ফাইল কেবিনেট, ৫০টি আর্ম কুশন স্টিল চেয়ার, ১৮টি আর্মলেস স্টিল কুশন চেয়ার, ৩০টি স্টিল আলমারি, ৫০টি নার্স চেয়ার, ১০টি করে কম্পিউটার চেয়ার ও টেবিল। তবে চালানের তথ্যের সঙ্গে মালপত্রের প্রকৃত সংখ্যার মিল নেই, যার প্রমাণ মেলে সার্ভে প্রতিবেদনে।

চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সার্ভে কমিটি হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ককে সার্ভে প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, কার্যাদেশে ২৫ ধরনের আসবাবের মধ্যে মাত্র ৭ ধরনের আসবাব সরবরাহ করা হয়েছে। ফাইল কেবিনেট ৪৫টি এবং স্টিল আলমারি ৩০টি সরবরাহ করা হলেও হাসপাতালের স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে মিল নেই। এ ছাড়া আর্ম কুশন চেয়ার ৫০টির পরিবর্তে ৪৯টি, আর্মলেস কুশ স্টিল চেয়ার ১৮টির পরিবর্তে ১৭টি, নার্স চেয়ার ৫০টির স্থলে ৪৯টি সরবরাহ করা হয়েছে। কম্পিউটার চেয়ার ও টেবিল ১০টি করে সরবরাহ করা হলেও সেগুলো একেবারেই মানসম্মত নয়। সার্ভে কমিটির সভাপতি ডা. তাবিন্দ আনজুম আজিজ, সদস্যসচিব ডা. মোছা. জাহানারা ফেরদৌস এবং সদস্য ডা. সি এম শামীম কবির সই করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, এখনো চূড়ান্ত সার্ভে হয়নি। তাই হিসাবে গরমিল হলো কি না বলা যাচ্ছে না।

মা নিয়ে উক্তি