বর্তমান যুগে প্রচণ্ড গরমে মানুষের পানির তৃষ্ণা মেটাতে হাতের কাছেই পাওয়া যায় সুপেয় পানির বোতল, বাসাবাড়িতে নিশ্চিত হয়েছে নিরাপদ পানির সরবরাহও। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন সুপেয় পানির জন্য একমাত্র ভরসা ছিল শহরের ‘ভিস্তিওয়ালা’রা।

এরাই একদিন বাড়িতে বাড়িতে সুপেয় শীতল পানি পৌঁছে দিতেন।

আরও পড়ুন জীবন নিয়ে বিখ্যাত ১০০ উক্তি

তবে ষাটের দশকেই ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এই পেশা। ভারতের কলকাতায় কোনও কোনও এলাকায় অবশ্য এখনও এই পেশা টিঁকে রয়েছে।

অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন জায়গার মতো ঢাকাতেও খাবার পানির জন্য এক সময় নির্ভর করতে হতো খাল, নদী বা কুয়ার উপর।

সাধারণত শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানির উপর নির্ভর করতে হত ঢাকার নাগরিকদের।

যে সব কুয়া ছিলো তাতেও ছিল সুপেয় পানির অভাব। সে সময় এই ভিস্তিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানি সরবরাহ করতেন।

ভিস্তিওয়ালা কারা ?

ঢাকার ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন গ্রন্থে ভিস্তিওয়ালাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে।

ঢাকায় ভিস্তিদের অস্তিত্ব নিয়ে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইতে বিস্তারিত লেখা হয়েছে।

অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ষাটের দশকে আমিও ভিস্তিওয়ালাদের ঢাকায় দেখেছি। তখন সুপেয় পানির লাইনের সংকট ছিল।”

“এই পেশার মানুষেরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পানি সরবরাহ করত। তাদের কাছে থাকা একটি চামড়ার বিশাল মশকে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানি দিতেন তারা।”

‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ এরকম হাঁক দিয়ে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানি সরবরাহ করত বলে জানান মি. মামুন।

ইতিহাসের প্রথম ভিস্তি ছিলেন ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘আব্বাস’।

কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধের সময় দামেস্কে ইমাম হোসেন ও তার সেনাবাহিনীর জন্য ইউফ্রেটিস নদী থেকে মশকে করে পানি বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় তীরের আঘাতে মারা যান এই ভিস্তিওয়ালা আব্বাস।

এই ভিস্তিওয়ালারা বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যুদ্ধের সময় তারা তাদের বিশেষ পানির ব্যাগ ‘মশক’ নিয়ে যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করতো।

আব্বাসের নামানুসারে পরবর্তীতে এই সম্প্রদায়কে ‘আব্বাসী’ উপাধি দেয়া হয়।

ইতিহাসের বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া যায়, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকেই ভিস্তিরা এসেছিল।

আরব থেকে আসা সুন্নি মুসলিম গোষ্ঠী থেকে যেমন ছিল, তেমনি দলিত সম্প্রদায় থেকে আসা মানুষজনও এই পেশায় নিয়োজিত ছিল।

আরব থেকে আসা মানুষরা মুঘলদের অনুসরণ করে ভারতবর্ষে এসেছিল। পরে উত্তর ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে তারা বসতি তৈরি করে।

এরা আব্বাসী, শেখ আব্বাসী এবং সাক্কা নামে পরিচিত ছিলো। শেখ আব্বাসি আরব গোত্র বনু আব্বাসের অন্তর্গত।

ভিস্তিরা ঐতিহ্যগতভাবে সামরিক বাহিনীতে পানি পরিবহনের কাজ করতো।

তবে, এই ‘ভিস্তি’ নামটি কিভাবে এসেছে তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত রয়েছে।

কেউ কেউ ধারণা করেন ‘ভিস্তি’ শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘বেহেশত’ থেকে, যার অর্থ ‘স্বর্গ’।

ইতিহাসের বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া যায়, মুঘল আমলে লালবাগ কেল্লায় ভিস্তিরা মশকে পানি ভর্তি করে নিয়ে যেত।

যে কোনও ধর্মীয় উৎসব, অনুষ্ঠান বা সমাবেশে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকতেন এই পেশাজীবীরা।

পঞ্চাশের দশকে সাহিত্য ও বিনোদনমূলক মাসিক পত্রিকা রূপছায়ার প্রকাশক ছিলেন ঢাকার বাসিন্দা মীজানুর রহমান।

তার লেখা ‘ঢাকা পুরাণ’ বইয়ে বলা হয়েছে, মুঘল আমলে যে সব বাড়িতে কলের পানি ছিল না, সেখানে ভিস্তিওয়ালারাই ছিল একমাত্র সহায়।

ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের ‘সাক্কা’ বলা হতো।

মুঘল আমলে এবং ১৮৭৮ সালে ঢাকায় পানির কল প্রতিষ্ঠার আগে নগরবাসীদের এই পেশাজীবীরা পানি সরবরাহ করতেন।